বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : পেকুয়ায় বিভিন্ন পূজামন্ডপ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বসত বাড়ীতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের নেপথ্যে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত এবং হেফাজত ইসলামের নেতা-কর্মিদের ইন্ধনের অভিযোগ উঠেছে।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ অভিযোগ করেন।
তবে এ নিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, হামলার ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। এতে তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সকালে পেকুয়া উপজেলায় উগ্রবাদীদের হামলায় বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত পূজামন্ডপ ও বাড়ী-ঘর পরিদর্শনে যান জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আইনজীবী রনজিত দাশ ও সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা’র নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।
দলটির সদস্যরা পেকুয়া সদর ইউনিয়নের বিশ্বাস পাড়া ও শীল পাড়া, শিলখালী ইউনিয়নের কাছারী মুরা শীল পাড়া এবং মগনামা ইউনিয়নের শীল পাড়াসহ উগ্রবাদীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তারা ( পূজা উদযাপন পরিষদের প্রতিনিধি দল ) হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন।
বুধবার সন্ধ্যায় একদল উগ্রবাদী দূর্বৃত্ত মিছিল সহকারে উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশ্বাস পাড়ার পূজামন্ডপে হামলা ও ভাংচুর চালায়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে হামলাকারিদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এক পর্যায়ে হামলাকারিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি বসত বাড়ীতে ভাংচুর চালানো হয়।
এ ঘটনার পর রাতে পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকায় উগ্রবাদীরা খন্ড খন্ড মিছিল বের করে। এসব মিছিল থেকে শিলখালীর কাছারী মুরা শীল পাড়া ও মগনামার শীল পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার পূজামন্ডপে এবং হিন্দুদের বাড়ীতে হামলা চলিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
কুমিল্লায় একটি পূজামন্ডপে ‘কোরআন শরীপ অবমাননার’ কথিত ছবি ও ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়ার জেরে পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন পূজামন্ডপ ও হিন্দু পল্লীতে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের প্রতিনিধি দলের দেয়া তথ্য মতে, পেকুয়ায় সহিংসতার ঘটনায় উগ্রবাদীরা বিভিন্ন স্থানে ৭ টি পূজামন্ডপ, ৩০ টি বাড়ী ভাংচুর ও ১ টি বাড়ীতে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “ স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত ইসলামের নেতা-কর্মিরা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে সরকারবিরোধীরা এ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ”
বুধবার রাতে পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশ্বাস পাড়ার পূজামন্ডপ ও হিন্দু পল্লীতে হামলাকারি উগ্রবাদীদের মিছিলে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের নেপথ্যে ইন্ধন যুগিয়েছে তারা সরকারবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত ইসলামের নেতা-কর্মি বলে দাবি করেন, স্থানীয় এ উপজেলা চেয়ারম্যান।
স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত ইসলামের নেতা-কর্মিদের বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিযোগ উঠেছে মগনামা ইউনিয়নের শীল পাড়ার হিন্দু পল্লীতে হামলার ঘটনায়ও।
বুধবার সকালে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল মগনামায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী এই অভিযোগ করেন। শুধু হামলার ঘটনা সংঘটনে নয়, নেপথ্যে ইন্ধনদাতারা এখন তৎপর হামলাকারিদের বাঁধা দানকারি স্থানীয় এলাকাবাসীকে ঘটনায় দায়ের মামলায় আসামি করতেও। এসব কূট-কুশীলবরা পুলিশকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে স্থানীয় নিরাপরাধ লোকজনকে হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ছাত্র শিবিরের সাবেক ক্যাডার ও গত ইউপি নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিল থেকেই মগনামার শীল পাড়ার হিন্দু পল্লীতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ওই মিছিলটির শুরুতে ওয়াসিম নিজে উপস্থিত থাকলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই সটকে পড়েন।
শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবিরের সাবেক ক্যাডার। তিসি দলটির সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজমের দেহরক্ষী ছিলেন। পরে বিগত ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এতে ভারতে নির্বাসিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদের আর্শীবাদ পুষ্টতা পান। ওয়াসিম বিএনপির গত উপজেলা কমিটির আপ্যায়ন ছিলেন। গত ইউপি নির্বাচনে বিএনপির সমর্থনে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
উগ্রবাদীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মগনামার শীল পাড়া পরিদর্শনকালে পূজা উদযাপন পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গেও কথা বলেন।
এসময় স্থানীয় নুইন্ন্যা পাড়ার বাসিন্দা মকছুদ মিয়া বলেন, মগনামার শীল পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে স্থানীয় এলাকাবাসীর কোন ধরণের বিরোধ নেই। বুধবার রাতে পেকুয়া সদরের বিশ্বাস পাড়ায় পূজামন্ডপ ও হিন্দু বাড়ীঘরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনার পর মগনামায়ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিছু উগ্রবাদী মিছিল সংঘটিত করে শীল পাড়ার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
“ দুইটি মিছিল শ্লোগান সহকারে শীল পাড়ার হিন্দু পল্লীতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ সংঘটিত করে। এর একটিতে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম এবং অপরটিতে অংশ নেয় সাধারণ লোকজন। ওয়াসিমের নেতৃত্বের মিছিলটি শীল পাড়ার কাছাকাছি আসার আগেই তিনি সটকে পড়েন। ওই মিছিল থেকেই হিন্দু পল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে হিন্দুদের ৭টি বাড়ী ভাংচুর ও ১ টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ”
স্থানীয় এ বাসিন্দা বলেন, “ ওয়াসিমের নেতৃত্বে আসা মিছিলটি শীল পাড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে স্থানীয় এলাকাবাসী সংঘটিত হয়ে বাধা দেন। কিন্তু হামলাকারিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো দেশিয় অস্ত্র থাকায় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে মিছিলটি শীল পাড়ায় হিন্দুদের বাড়ী ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে এলাকাবাসী আবারো সংঘটিত হয়ে ঘটনাস্থলে এগিয়ে গেলে হামলাকারিরা পালিয়ে যায়। ”
“পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিমও সেখানে উপস্থিত হন। এসময় তার (ওয়াসিম) সমর্থিত স্থানীয় লোকজনকে শিখিয়ে দেন পুলিশকে যেন স্বাক্ষ্য দেয়, আমি (মকছুদ) ও আমার ভাই মোস্তাক হামলাকারিদের সঙ্গে মিছিলে ছিলাম। পরে পুলিশ বাড়ীতে গিয়ে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের খুঁজতে থাকে। ”
মকছুদ পূজা উদযাপন পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের উপস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে হামলাকারিদের তিনি ছিলেন কিনা জানতে চান।
এসময় সেখানে উপস্থিত খুকি রাণী শীল বলেন, মকছুদ হামলায় অংশ নেয়নি। বরং হামলাকারিদের প্রতিরোধে এলাকাবাসীর সঙ্গে তার (মকছুদ) পরিবারের সদস্যরা এবং স্থানীয় ইউপি সদস্য রশিদ আহমদ ছিলেন। তারা না এগিয়ে না আসলে পুরো হিন্দু পল্লী হামলাকারিরা আগুনে ছাই করে দিত।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও মগনামা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রশিদ আহমদ বলেন, আগামী ইউপি নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিমের মূল প্রতিদ্বন্ধী হবে আওয়ামী লীগের মনোনীত দলীয় প্রার্থী। মূলত: নির্বাচনে ফায়দা হাসিলের জন্য উগ্রবাদীদের উস্কানি দিয়ে চেয়ারম্যান ওয়াসিম মিছিল নিয়ে হিন্দু পল্লীতে হামলা সংঘটন করেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, হামলা পরবর্তী ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মি ও সমর্থকদের হামলার ঘটনায় জড়িত অভিযোগ তুলে পুলিশকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশকে ব্যবহার করে নিরাপরাধ লোকজনকে ঘটনায় জড়িত অভিযোগে আটক করিয়েছে।
ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মিদের হয়রানির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে মগনামার ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিমের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কল রিসিভ না করায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply